সকালবেলা আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা

সৈয়দ বোরহান কবীর: ঠিক ১০ বছর আগের ঘটনা। একটি কর্মশালায় যোগ দিতে ফরিদপুর গেলাম। ফরিদপুর শহরের মাঝামাঝি হঠাৎ পুলিশ গাড়ি আটকে দিল। শুধু আমাদের নয়, চারপাশের সব যানবাহন আটকে দেওয়া হলো। পুলিশের ভীষণ ব্যস্ততা। একটু বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার ভাই। পুলিশ ফিসফিস করে বললেন ভিআইপি মুভমেন্ট। আমি একটু উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম, কে? উত্তর এলো বাবর স্যার। আমি এবার বিরক্ত হলাম। বললাম, বাবর তো জেলে। এবার পুলিশের ওই ছোট কর্তা আমার ওপর ভীষণ খেপে গেলেন। এই প্রথম আমার দিকে তাকালেন। তাকানোর ভঙ্গি এমন যেন আমাকে এক্ষুনি গিলে খাবেন। প্রায় ধমক দিয়ে বললেন, সরেন এখান থেকে। আমি খুবই কষ্ট পেলাম। এত দিন রাজনীতির খোঁজখবর রাখি অথচ বাবর স্যারকে চিনি না! এই না চেনাটা আমার কাছে অপরাধ মনে হলো। ফরিদপুরে কর্মশালা শুরুর আগে চা পান করতে করতে দু-এক জন সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে তারা যেন ইলেকট্রিক শক খেলেন। বাবর কে? এ প্রশ্ন করাই যেন এক অপরাধ। সাংবাদিকদের চেহারায় অস্বস্তি দেখে আমার অপরাধবোধ আরও বেড়ে গেল। দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর কর্মশালার আয়োজক তরুণ সাংবাদিক আমাকে একটু দূরে টেনে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘ভাই, ফরিদপুরে বাবর স্যারকে নিয়ে কোনো কথা না বলাই ভালো। আপনি কর্মশালা করতে এসেছেন, এটা করে চলে যান।’ অনুজ সাংবাদিক আমাকে এও বললেন, ‘বাবর স্যার হলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই। তিনিই আসলে ফরিদপুর চালান। তার কথাই ফরিদপুরে শেষ কথা।’ ফরিদপুর থেকে ঢাকায় ফিরে পীযূষ দাকে ফোন করলাম। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কয়েকটি কাজের সূত্রে ঘনিষ্ঠতা। অভিনয়শিল্পীর চেয়েও তাঁর বড় পরিচয় তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি ফরিদপুর। প্রায়ই ফরিদপুরের নানা গল্প বলেন। পীযূষ দা-ই আমাকে প্রথম ফরিদপুরের আসল চিত্রটা বললেন। বললেন, ‘বাবর মন্ত্রীর ছোট ভাই, আগে বিএনপি করতেন। এখন আওয়ামী লীগের সর্বেসর্বা। ফরিদপুরে আওয়ামী দুঃসময়ে যারা হাল ধরেছিলেন তারা এখন বিরোধী দল। আগে যারা বিএনপি-জামায়াত করতেন তারাই এখন আওয়ামী লীগ।’ পীযূষ দার কথায় আমার ভুল ভাঙল। কেন পুলিশ আমাকে ধমক দিয়েছিল, কেন সাংবাদিকরা বাবর কে- এ প্রশ্নের উত্তর আমাকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এ রকম সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম। তারপর এক দশক কেটে গেল। গত ৮ মার্চ সকালেই টেলিভিশন স্ক্রলে দেখলাম খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পত্রিকায় তার ছবিটা দেখলাম। ক্লান্ত, পরাজিত এক মানুষ। আচমকাই আমার কাজী নজরুল ইসলামের গানের সেই পঙ্ক্তিটি মনে পড়ে গেল- ‘সকালবেলা আমির রে ভাই, ফকির সন্ধ্যাবেলা’। বাবর কি জানতেন তার এ পরিণতি হবে? ২০১২ সালে ফরিদপুরে তার যাতায়াতের পথে কোনো যানবাহন চলতে দেওয়া হতো না। আর এখন তার হাতে হাতকড়া। বাবরকে নিয়ে গণমাধ্যমে গত কয়েক দিন ফলাও করে খবর বেরোচ্ছে। কীভাবে তিনি মুরগি বাবর থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হলেন। ফরিদপুরে সব টেন্ডারে তিনি ১৫ শতাংশ হারে কমিশন নিতেন। তার কথা ছাড়া কেউ কোনো কাজ পেত না। ২ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা অর্থ পাচার মামলায় তিনি অভিযুক্ত। বাবরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠছে তা যাচাই করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত। কিন্তু বাবর গ্রেফতার হওয়ার পর দেখলাম ফরিদপুরে আনন্দ উৎসব। মিষ্টি বিতরণ হচ্ছে। একজন যে কোনো স্তরের রাজনীতিবিদের জন্য আসল আদালত হলো জনতার আদালত। বিচারিক আদালতের চেয়ে জনতার আদালতের রায়ই রাজনীতিবিদদের ভাগ্য নির্ধারণ করে। জনতার আদালতে বাবর দোষী, অপরাধী। ১০ বছর টইটম্বুর ক্ষমতার মধ্যে ছিলেন। যা খুশি তা-ই করেছেন। অঢেল সম্পদ বানিয়েছেন কিন্তু জনতার ভালোবাসা অর্জন করতে পারেননি এক ফোঁটাও। জনগণ ঘৃণাভরে অপেক্ষা করেছে বাবরের আজকের পরিণতি দেখার জন্য।

 

রাজনীতিতে আমির থেকে ফকির হওয়ার ঘটনা ঘটে ক্ষমতার পালাবদল হলে। রাজনীতিবিদদের জন্য ক্ষমতার মসনদ আর কারাগারের দূরত্ব মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতোই। কিন্তু খন্দকার মোহতেশাম হোসেনের জন্য ব্যাপারটা তা নয়। ২০০৯ সাল থেকে বাবর যে দলের পরিচয় দিয়ে ‘আমির’ হয়ে উঠেছিলেন সেই দল আওয়ামী লীগই এখন ক্ষমতায়। যে দলের প্রভাব খাটিয়ে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন সে দলই এখন দেশ চালাচ্ছে। শুধু বাবরের সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। এজন্য শেখ হাসিনার তীব্র সমালোচকরা তাঁকে একটা ছোট্ট ধন্যবাদ দিতেই পারেন। এই একটি ঘটনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক বার্তা দিয়েছেন। কঠোর বার্তা। এই গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে আরেকবার প্রমাণ করলেন নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে একবিন্দু ছাড় দেওয়ার মানুষ নন প্রধানমন্ত্রী। আমাদের ঝাপসা স্মৃতি একটু পরিষ্কার করে নিতে চাই এ সুযোগে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করেছিলেন। শেখ হাসিনা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এরপর একে একে ক্যাসিনো বাণিজ্যের হোতাদের গ্রেফতার করেছেন। দলের অনেক দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় এনেছেন। এ শুদ্ধি অভিযানের সর্বশেষ উদাহরণ বাবর। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা নির্ভীক, সাহসী। দুর্বৃত্তের পরিচয় দেখেননি তিনি। এভাবে নিজের দলের ভিতর অনাসৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আর কোনো দলীয় প্রধান ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। আমি জানি, আমার এ বক্তব্যের সঙ্গে অনেকে একমত হবেন না। অনেকে নানা দুর্নীতির ফিরিস্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করবেন, কই এসবের বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কিন্তু কেউ কি একবার ভেবে দেখেছেন, কি এক অদম্য সাহসী এক সংস্কৃতি চালু করেছেন শেখ হাসিনা। গত তিন বছরে তিনি নিজের দলের অন্তত ২ হাজার নেতা-কর্মীকে আইনের আওতায় এনেছেন। ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দিয়েছেন। ঢাকার রাজনীতিতে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। বাবরের মতো হাইব্রিড নন, সংগঠনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দুঃসময়ে দলের জন্য কাজ করেছেন। তাতে কি? যখনই সীমালঙ্ঘন করেছেন তখনই তাকে আইনের আওতায় এনেছেন। দুঃসময়ে সাহসী ভূমিকা পালন করলেই কি অন্যায় করার লাইসেন্স পাওয়া যায়? আওয়ামী লীগে যারা এসব দেখেও বোঝে না, তারা হয়তো শেখ হাসিনার সংকেত বুঝতে ব্যর্থ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ঘুষখোররা শেখ হাসিনার হাত থেকে রক্ষা পাবে না। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আজ যারা দুর্নীতি করে আয়েশে গা ভাসাচ্ছে। যারা মনে করছে আওয়ামী লীগ করে তো অনেক কষ্ট করলাম, এবার একটু ফুর্তি করি- তাদের বোঝা উচিত শেখ হাসিনা সবার গোপন কুঠিরের খবর রাখেন। কখন কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন তা তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। যারা কদিন আগেও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বেড়াতেন তারা এখন অজানা শঙ্কায় ঘরে স্বেচ্ছাবন্দি। আজ যারা নিজেদের প্রচণ্ড প্রভাবশালী মনে করেন। সব বিষয়ে যারা নিজেদের নোংরা নাকটা গলান তাদের অনুরোধ করব সকাল বেলা আমির রে ভাই… গানটা ঠাণ্ডা মাথায়, একান্তে, বাতি নিভিয়ে শুনতে। কারণ আদর্শ ও নীতি ছাড়া আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছে কিছুই অপরিহার্য নয়। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেন, দেখেন তারপর ভালো হয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ দেন। সতর্কও করেন। তারপর ব্যবস্থা নেন। অবশ্য যারা মতলববাজ, হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী তারা তো নীতি-আদর্শের থোড়াই কেয়ার করে। এজন্য শেখ হাসিনা কী চান, তাঁর চিন্তা-দর্শন কী এও তারা বোঝে না। এরা মনে করে, ক্ষমতা হলো লুটপাটের এক মেলা। শেখ হাসিনার বার্তা বোঝার মতো মেধা যদি এদের থাকত তাহলে এরা এমন নির্লজ্জ, বেহায়া হতো না। আমি গুনে গুনে দেখেছি ১৩ বছরের বেশি বয়সী আওয়ামী লীগ সরকারে হাতে গোনা দুই ডজনের মতো মতলববাজ রয়েছে। যারা আওয়ামী লীগের পরিচয় ব্যবহার করে নানা অপকর্ম করছে। এদের সবাই চেনে। আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলে কোটি নেতা-কর্মী সৎ। বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় আছেন, জাতির পিতার হত্যার বিচার হয়েছে, রাজাকারদের দাপট নেই- ব্যস, এতে খুশি আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী। বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালান। টিসিবির লাইনে সয়াবিন তেলের জন্য অপেক্ষা করেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। হাতে গোনা কয়েকজন সুবিধাবাদী, অন্যায়কারীর কারণে সৎ কর্মীদের বদনাম হয়। গোটা আওয়ামী লীগ এবং সরকারের সুনাম নষ্ট হয়। ইদানীং কিছু ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ গোছের ব্যক্তিকে ক্ষমতা কেন্দ্রে বেশ দৃশ্যমান দেখা যায়। এরা এমন ভাবসাব করে মনে হয় এরাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এদের জন্য আমার ভীষণ করুণা হয়। কৌতুক জাগ্রত হয়। কারণ এরা জানে না শেখ হাসিনা ছাড়া এদের চার পয়সারও মূল্য নেই। শেখ হাসিনা এদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে এদের একেকজনের পরিণতি বাবরের মতোই হবে। এরা আসলে চাঁদের মতো। নিজের আলো নেই, শেখ হাসিনার আলোয় এরা আলোকিত। বাবরের অবস্থা দেখে এরা কি একটু সংযত হবে? এরা সংযত হোক না হোক শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে এরা যে টিকবে না তা আমি হলফ করেই বলতে পারি। এদেরও বাবরের মতো পরিণতি দেখার ভারি শখ আমার। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এসব অপরিণামদর্শী দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় আনবেন এ ব্যাপারে আমি অন্তত নিশ্চিত।

 

বাবররা ভাগ্যবান। আদালতের রায়ে তার জেল হোক, কিংবা তিনি ছাড়া পান, তার নাম খন্দকার মোহতেশাম হোসেন এটি অক্ষত থাকবে। শেখ হাসিনা বাবর এবং অন্য দুর্বৃত্তদের নিজ পরিচয় অক্ষত রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। কিন্তু একবার ভাবুন তো হারিছ চৌধুরীর কথা। নিজ পরিচয়ে মৃত্যুবরণটাও হলো না তার। বিএনপির রাজনীতির মতোই তার মিথ্যা পরিচয়, ভুয়া ভোটার কার্ড, ভুয়া পাসপোর্ট, সর্বশেষ মৃত্যুসনদটাও ভুয়া। শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী এ বয়সেও তরতাজা, সজীব। সংবাদের নেশায় এখনো ক্লান্তিহীন। ৬ মার্চ মানবজমিনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কী তা আরেকবার দেখিয়ে দিলেন। ‘হারিছ চৌধুরী নয় মাহমুদুর রহমান মারা গেছেন’ শিরোনামে তাঁর অনুসন্ধানী রিপোর্টটি চাঞ্চল্যকর, অসাধারণ। এ রিপোর্টে মতিউর রহমান চৌধুরী খুঁজে বের করেছেন হারিছ চৌধুরীর পরিচয় বদলের আদ্যোপান্ত। পান্থপথে হারিছ চৌধুরীর আত্মগোপন, নতুন নাম ধারণ সব যেন থ্রিলার। তার পরও এ নিয়ে অনেকের সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস। পুরো ঘটনা দেখে শুনে আমার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী ছোটগল্প ‘জীবিত ও মৃত’র কথা মনে পড়ল। এ ছোটগল্পের কাহিনি বোধকরি সবারই জানা। এর একটি বাক্য বহুল প্রচলিত এবং আলোচিত। বাক্য হলো, ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’ হারিছ চৌধুরী সত্যি যদি মাহমুদুর রহমান নাম নিয়ে মৃত্যুবরণ না করেন তাহলে কাদম্বিনীর মতো আত্মহত্যা করে তাকে তার পরিচয় উদ্ধার করতে হবে। ‘মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে তিনি মরেন নাই’। যদি সত্যি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে ইতিহাসে কাপুরুষ, দুর্নীতিবাজ এক রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবে আলোচিত হতে থাকবেন।

 

বাবর এবং হারিছ চৌধুরীর ঘটনা দুটি আপাতবিচ্ছিন্ন কিন্তু একসূত্রে গাঁথা। রাজনীতির পরিচয়ে অন্যায়, স্বেচ্ছাচারিতার পরিণতি ভয়াবহ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত হারিছ চৌধুরী ছিলেন কি অসীম ক্ষমতাবান। রাজা-বাদশাহদেরও এত ক্ষমতা থাকে না, যা এই ব্যক্তিটির ছিল। হারিছ চৌধুরীর স্বেচ্ছাচারিতার একটা উদাহরণ দিতে চাই। ২০০৩ সালের ঘটনা। স্বাস্থ্য খাতে তিল তিল করে সমৃদ্ধি অর্জন করা এক ব্যবসায়ীর কাছে ফোন এলো এক সন্ধ্যায়। অন্য প্রান্ত থেকে বলা হলো, ‘প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী স্যার কথা বলবেন’। ব্যবসায়ী ভদ্রলোক রাজনীতির সাতেপাঁচে নেই। একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। ফোনটা কেটে দিলেন। এরপর আবার ফোন, আবার…। বিরক্ত হয়ে ভদ্রলোক ফোনটাই বন্ধ করে দিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি তার প্রতিষ্ঠান থেকে বেরোলেন বাসার উদ্দেশে। কিছুদূর যেতেই দুটো গাড়ি সামনে পেছনে থেকে তার গাড়ি আটকে দিল। গাড়ি দুটো থেকে কয়েকজন বেরিয়ে ঘিরে ধরল গাড়ি। কিছু বোঝার আগেই গাড়ি থেকে নেমে এলো সশস্ত্র অস্ত্রধারীরা। মুহূর্তেই ওই ব্যবসায়ীর চোখ বাঁধা হলো। ওই ব্যবসায়ীকে এক বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চালানো হলো নির্মম নির্যাতন। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। যখন জ্ঞান ফিরল তখনো তার হাত-পা-চোখ বাঁধা। চোখ খুলে দেওয়া হলো এক পর্যায়ে। একটু ধাতস্থ হতেই দেখলেন সামনে হারিছ চৌধুরী। ১০ কোটি টাকা দিয়ে সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচেছিলেন নিরীহ ভদ্রলোক। কোনো মামলা করেননি। কাউকে বলারও সাহস পাননি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় এ কথাগুলো একবারই প্রকাশ্যে বলেছিলেন। এরপর তাকে মামলা করতে বলা হলে বিদেশ চলে যান। সেও ভয়ে। অনেক পরে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মামলা করলেন না কেন। তিনি বলেছিলেন, হারিছ চৌধুরীরা ভয়ংকর। এরা আবার কখনো যদি ক্ষমতায় আসে আমাকে শেষ করে ফেলবে। কি প্রচণ্ড প্রতাপশালী হারিছ চৌধুরীর ১৪টি বছর কি দুঃসহ গ্লানিকর এক জীবন কেটেছে। ভাবা যায়। তাহলে কেন এত লোভ, এত কেন ক্ষমতার মোহ। কী হবে এসব দিয়ে। খন্দকার মোহতেশাম হোসেনেরও তো একই অবস্থা ছিল। ফরিদপুরে তাকে নাকি বলা হতো ‘ছোট রাজা’। আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার করেছেন। এখন কী হলো?

 

আমরা সবাই যদি অন্যায়ের পরিণতির কথা ভাবতাম তাহলে কি এত অন্যায়, দুর্নীতি, লুটপাট হতো? কিন্তু বাস্তবতা হলো স্বেচ্ছাচারিতার, সীমালঙ্ঘনের সময় কেউ পরিণতির কথা ভাবে না। মনে করে তারা অবিনশ্বর, চিরন্তন। কিন্তু সকালে আমির হয়ে বিকালে ভিখারিতে পরিণত হওয়ার চেয়ে সারা জীবন সাদামাটা সৎ একটা জীবন যে অনেক শান্তির তা বুঝতে কারও কারও এত কষ্ট কেন? এখন সমাজে হাতে গোনা যে কজন নব্য হারিছ কিংবা বাবর আছেন, তারা এসব দেখে কি কিছু শিখবেন?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

Email : [email protected]        সূএ:  বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



» ছাত্র আন্দোলনে হামলাকারী ঢাবির ছাত্রলীগ নেতা ইমনকে গ্রেফতার

» গুলিভর্তি ম্যাগাজিন চুরি: ৮ হাজার শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে পুলিশের মামলা

» একদিনের ব্যবধানে কমল স্বর্ণের দাম

» নাগরিক কমিটিতে যুক্ত হলেন সারজিসসহ আরও ৪৫ জন

» সকল ছাত্রসংগঠনের সমন্বয়ে ‘জাতীয় ছাত্র সংহতি সপ্তাহ’ পালনের ঘোষণা

» অহিংস গণঅভ্যুত্থানের অন্যতম সংগঠক মাহবুবুল আলম গ্রেপ্তার

» চিন্ময় কৃষ্ণকে গ্রেপ্তার: প্রতিবাদে ডিবির সামনে সনাতনী জাগরণ মঞ্চ

» ডিবি হেফাজতে সনাতন জাগরণ মঞ্চের চিন্ময় কৃষ্ণ

» অহিংস গণঅভ্যুত্থান বাংলাদশের আহ্বায়ক আ ব ম মোস্তফা আমীন আটক

» ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত ৮ দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে জামায়াত আমিরের সাক্ষাৎ

  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Desing & Developed BY PopularITLtd.Com
পরীক্ষামূলক প্রচার...

সকালবেলা আমির রে ভাই ফকির সন্ধ্যাবেলা

সৈয়দ বোরহান কবীর: ঠিক ১০ বছর আগের ঘটনা। একটি কর্মশালায় যোগ দিতে ফরিদপুর গেলাম। ফরিদপুর শহরের মাঝামাঝি হঠাৎ পুলিশ গাড়ি আটকে দিল। শুধু আমাদের নয়, চারপাশের সব যানবাহন আটকে দেওয়া হলো। পুলিশের ভীষণ ব্যস্ততা। একটু বিরক্ত হয়ে গাড়ি থেকে নামলাম। জিজ্ঞেস করলাম কী ব্যাপার ভাই। পুলিশ ফিসফিস করে বললেন ভিআইপি মুভমেন্ট। আমি একটু উৎসুক হয়ে জানতে চাইলাম, কে? উত্তর এলো বাবর স্যার। আমি এবার বিরক্ত হলাম। বললাম, বাবর তো জেলে। এবার পুলিশের ওই ছোট কর্তা আমার ওপর ভীষণ খেপে গেলেন। এই প্রথম আমার দিকে তাকালেন। তাকানোর ভঙ্গি এমন যেন আমাকে এক্ষুনি গিলে খাবেন। প্রায় ধমক দিয়ে বললেন, সরেন এখান থেকে। আমি খুবই কষ্ট পেলাম। এত দিন রাজনীতির খোঁজখবর রাখি অথচ বাবর স্যারকে চিনি না! এই না চেনাটা আমার কাছে অপরাধ মনে হলো। ফরিদপুরে কর্মশালা শুরুর আগে চা পান করতে করতে দু-এক জন সাংবাদিককে জিজ্ঞেস করলাম। আমার প্রশ্ন শুনে তারা যেন ইলেকট্রিক শক খেলেন। বাবর কে? এ প্রশ্ন করাই যেন এক অপরাধ। সাংবাদিকদের চেহারায় অস্বস্তি দেখে আমার অপরাধবোধ আরও বেড়ে গেল। দুপুরে মধ্যাহ্নভোজের বিরতির পর কর্মশালার আয়োজক তরুণ সাংবাদিক আমাকে একটু দূরে টেনে নিয়ে গেলেন। বললেন, ‘ভাই, ফরিদপুরে বাবর স্যারকে নিয়ে কোনো কথা না বলাই ভালো। আপনি কর্মশালা করতে এসেছেন, এটা করে চলে যান।’ অনুজ সাংবাদিক আমাকে এও বললেন, ‘বাবর স্যার হলেন ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেনের ছোট ভাই। তিনিই আসলে ফরিদপুর চালান। তার কথাই ফরিদপুরে শেষ কথা।’ ফরিদপুর থেকে ঢাকায় ফিরে পীযূষ দাকে ফোন করলাম। পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে কয়েকটি কাজের সূত্রে ঘনিষ্ঠতা। অভিনয়শিল্পীর চেয়েও তাঁর বড় পরিচয় তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা। বাড়ি ফরিদপুর। প্রায়ই ফরিদপুরের নানা গল্প বলেন। পীযূষ দা-ই আমাকে প্রথম ফরিদপুরের আসল চিত্রটা বললেন। বললেন, ‘বাবর মন্ত্রীর ছোট ভাই, আগে বিএনপি করতেন। এখন আওয়ামী লীগের সর্বেসর্বা। ফরিদপুরে আওয়ামী দুঃসময়ে যারা হাল ধরেছিলেন তারা এখন বিরোধী দল। আগে যারা বিএনপি-জামায়াত করতেন তারাই এখন আওয়ামী লীগ।’ পীযূষ দার কথায় আমার ভুল ভাঙল। কেন পুলিশ আমাকে ধমক দিয়েছিল, কেন সাংবাদিকরা বাবর কে- এ প্রশ্নের উত্তর আমাকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। এ রকম সব প্রশ্নের উত্তর পেয়েছিলাম। তারপর এক দশক কেটে গেল। গত ৮ মার্চ সকালেই টেলিভিশন স্ক্রলে দেখলাম খন্দকার মোহতেশাম হোসেন বাবরকে ঢাকা থেকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পত্রিকায় তার ছবিটা দেখলাম। ক্লান্ত, পরাজিত এক মানুষ। আচমকাই আমার কাজী নজরুল ইসলামের গানের সেই পঙ্ক্তিটি মনে পড়ে গেল- ‘সকালবেলা আমির রে ভাই, ফকির সন্ধ্যাবেলা’। বাবর কি জানতেন তার এ পরিণতি হবে? ২০১২ সালে ফরিদপুরে তার যাতায়াতের পথে কোনো যানবাহন চলতে দেওয়া হতো না। আর এখন তার হাতে হাতকড়া। বাবরকে নিয়ে গণমাধ্যমে গত কয়েক দিন ফলাও করে খবর বেরোচ্ছে। কীভাবে তিনি মুরগি বাবর থেকে হাজার কোটি টাকার মালিক হলেন। ফরিদপুরে সব টেন্ডারে তিনি ১৫ শতাংশ হারে কমিশন নিতেন। তার কথা ছাড়া কেউ কোনো কাজ পেত না। ২ হাজার ৫৩৫ কোটি টাকা অর্থ পাচার মামলায় তিনি অভিযুক্ত। বাবরের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ উঠছে তা যাচাই করবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, আদালত। কিন্তু বাবর গ্রেফতার হওয়ার পর দেখলাম ফরিদপুরে আনন্দ উৎসব। মিষ্টি বিতরণ হচ্ছে। একজন যে কোনো স্তরের রাজনীতিবিদের জন্য আসল আদালত হলো জনতার আদালত। বিচারিক আদালতের চেয়ে জনতার আদালতের রায়ই রাজনীতিবিদদের ভাগ্য নির্ধারণ করে। জনতার আদালতে বাবর দোষী, অপরাধী। ১০ বছর টইটম্বুর ক্ষমতার মধ্যে ছিলেন। যা খুশি তা-ই করেছেন। অঢেল সম্পদ বানিয়েছেন কিন্তু জনতার ভালোবাসা অর্জন করতে পারেননি এক ফোঁটাও। জনগণ ঘৃণাভরে অপেক্ষা করেছে বাবরের আজকের পরিণতি দেখার জন্য।

 

রাজনীতিতে আমির থেকে ফকির হওয়ার ঘটনা ঘটে ক্ষমতার পালাবদল হলে। রাজনীতিবিদদের জন্য ক্ষমতার মসনদ আর কারাগারের দূরত্ব মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠের মতোই। কিন্তু খন্দকার মোহতেশাম হোসেনের জন্য ব্যাপারটা তা নয়। ২০০৯ সাল থেকে বাবর যে দলের পরিচয় দিয়ে ‘আমির’ হয়ে উঠেছিলেন সেই দল আওয়ামী লীগই এখন ক্ষমতায়। যে দলের প্রভাব খাটিয়ে তিনি হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন সে দলই এখন দেশ চালাচ্ছে। শুধু বাবরের সাম্রাজ্যের পতন ঘটেছে। এজন্য শেখ হাসিনার তীব্র সমালোচকরা তাঁকে একটা ছোট্ট ধন্যবাদ দিতেই পারেন। এই একটি ঘটনার মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অনেক বার্তা দিয়েছেন। কঠোর বার্তা। এই গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে আরেকবার প্রমাণ করলেন নীতি ও আদর্শের প্রশ্নে একবিন্দু ছাড় দেওয়ার মানুষ নন প্রধানমন্ত্রী। আমাদের ঝাপসা স্মৃতি একটু পরিষ্কার করে নিতে চাই এ সুযোগে। ২০১৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী দুর্নীতির বিরুদ্ধে শূন্য সহিষ্ণুতা নীতি গ্রহণ করেছিলেন। শেখ হাসিনা সুস্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছিলেন, ‘দুর্নীতিবাজদের কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’ এরপর একে একে ক্যাসিনো বাণিজ্যের হোতাদের গ্রেফতার করেছেন। দলের অনেক দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় এনেছেন। এ শুদ্ধি অভিযানের সর্বশেষ উদাহরণ বাবর। এ ব্যাপারে শেখ হাসিনা নির্ভীক, সাহসী। দুর্বৃত্তের পরিচয় দেখেননি তিনি। এভাবে নিজের দলের ভিতর অনাসৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে আর কোনো দলীয় প্রধান ব্যবস্থা নিয়েছেন বলে আমার জানা নেই। আমি জানি, আমার এ বক্তব্যের সঙ্গে অনেকে একমত হবেন না। অনেকে নানা দুর্নীতির ফিরিস্তি দিয়ে বলার চেষ্টা করবেন, কই এসবের বিরুদ্ধে তো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। কিন্তু কেউ কি একবার ভেবে দেখেছেন, কি এক অদম্য সাহসী এক সংস্কৃতি চালু করেছেন শেখ হাসিনা। গত তিন বছরে তিনি নিজের দলের অন্তত ২ হাজার নেতা-কর্মীকে আইনের আওতায় এনেছেন। ছাত্রলীগ সভাপতি-সাধারণ সম্পাদককে অব্যাহতি দিয়েছেন। ঢাকার রাজনীতিতে ইসমাইল চৌধুরী সম্রাটের জনপ্রিয়তা প্রশ্নাতীত। বাবরের মতো হাইব্রিড নন, সংগঠনের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন। দুঃসময়ে দলের জন্য কাজ করেছেন। তাতে কি? যখনই সীমালঙ্ঘন করেছেন তখনই তাকে আইনের আওতায় এনেছেন। দুঃসময়ে সাহসী ভূমিকা পালন করলেই কি অন্যায় করার লাইসেন্স পাওয়া যায়? আওয়ামী লীগে যারা এসব দেখেও বোঝে না, তারা হয়তো শেখ হাসিনার সংকেত বুঝতে ব্যর্থ। আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, চাঁদাবাজ, টেন্ডারবাজ, ঘুষখোররা শেখ হাসিনার হাত থেকে রক্ষা পাবে না। শুধু সময়ের অপেক্ষা মাত্র। আজ যারা দুর্নীতি করে আয়েশে গা ভাসাচ্ছে। যারা মনে করছে আওয়ামী লীগ করে তো অনেক কষ্ট করলাম, এবার একটু ফুর্তি করি- তাদের বোঝা উচিত শেখ হাসিনা সবার গোপন কুঠিরের খবর রাখেন। কখন কার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবেন তা তিনিই সিদ্ধান্ত নেবেন। যারা কদিন আগেও ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে বেড়াতেন তারা এখন অজানা শঙ্কায় ঘরে স্বেচ্ছাবন্দি। আজ যারা নিজেদের প্রচণ্ড প্রভাবশালী মনে করেন। সব বিষয়ে যারা নিজেদের নোংরা নাকটা গলান তাদের অনুরোধ করব সকাল বেলা আমির রে ভাই… গানটা ঠাণ্ডা মাথায়, একান্তে, বাতি নিভিয়ে শুনতে। কারণ আদর্শ ও নীতি ছাড়া আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কাছে কিছুই অপরিহার্য নয়। আমার মনে হয়, প্রধানমন্ত্রী সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেন, দেখেন তারপর ভালো হয়ে যাওয়ার একটা সুযোগ দেন। সতর্কও করেন। তারপর ব্যবস্থা নেন। অবশ্য যারা মতলববাজ, হাইব্রিড, অনুপ্রবেশকারী তারা তো নীতি-আদর্শের থোড়াই কেয়ার করে। এজন্য শেখ হাসিনা কী চান, তাঁর চিন্তা-দর্শন কী এও তারা বোঝে না। এরা মনে করে, ক্ষমতা হলো লুটপাটের এক মেলা। শেখ হাসিনার বার্তা বোঝার মতো মেধা যদি এদের থাকত তাহলে এরা এমন নির্লজ্জ, বেহায়া হতো না। আমি গুনে গুনে দেখেছি ১৩ বছরের বেশি বয়সী আওয়ামী লীগ সরকারে হাতে গোনা দুই ডজনের মতো মতলববাজ রয়েছে। যারা আওয়ামী লীগের পরিচয় ব্যবহার করে নানা অপকর্ম করছে। এদের সবাই চেনে। আওয়ামী লীগের মতো একটি রাজনৈতিক দলে কোটি নেতা-কর্মী সৎ। বঙ্গবন্ধুকন্যা ক্ষমতায় আছেন, জাতির পিতার হত্যার বিচার হয়েছে, রাজাকারদের দাপট নেই- ব্যস, এতে খুশি আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতা-কর্মী। বেশির ভাগ আওয়ামী লীগ কর্মী কঠোর পরিশ্রম করে সংসার চালান। টিসিবির লাইনে সয়াবিন তেলের জন্য অপেক্ষা করেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। হাতে গোনা কয়েকজন সুবিধাবাদী, অন্যায়কারীর কারণে সৎ কর্মীদের বদনাম হয়। গোটা আওয়ামী লীগ এবং সরকারের সুনাম নষ্ট হয়। ইদানীং কিছু ‘গায়ে মানে না আপনি মোড়ল’ গোছের ব্যক্তিকে ক্ষমতা কেন্দ্রে বেশ দৃশ্যমান দেখা যায়। এরা এমন ভাবসাব করে মনে হয় এরাই দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। এদের জন্য আমার ভীষণ করুণা হয়। কৌতুক জাগ্রত হয়। কারণ এরা জানে না শেখ হাসিনা ছাড়া এদের চার পয়সারও মূল্য নেই। শেখ হাসিনা এদের থেকে মুখ ফিরিয়ে নিলে এদের একেকজনের পরিণতি বাবরের মতোই হবে। এরা আসলে চাঁদের মতো। নিজের আলো নেই, শেখ হাসিনার আলোয় এরা আলোকিত। বাবরের অবস্থা দেখে এরা কি একটু সংযত হবে? এরা সংযত হোক না হোক শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগে এরা যে টিকবে না তা আমি হলফ করেই বলতে পারি। এদেরও বাবরের মতো পরিণতি দেখার ভারি শখ আমার। আওয়ামী লীগ সভানেত্রী এসব অপরিণামদর্শী দুর্বৃত্তকে আইনের আওতায় আনবেন এ ব্যাপারে আমি অন্তত নিশ্চিত।

 

বাবররা ভাগ্যবান। আদালতের রায়ে তার জেল হোক, কিংবা তিনি ছাড়া পান, তার নাম খন্দকার মোহতেশাম হোসেন এটি অক্ষত থাকবে। শেখ হাসিনা বাবর এবং অন্য দুর্বৃত্তদের নিজ পরিচয় অক্ষত রাখার নিশ্চয়তা দিয়েছেন। কিন্তু একবার ভাবুন তো হারিছ চৌধুরীর কথা। নিজ পরিচয়ে মৃত্যুবরণটাও হলো না তার। বিএনপির রাজনীতির মতোই তার মিথ্যা পরিচয়, ভুয়া ভোটার কার্ড, ভুয়া পাসপোর্ট, সর্বশেষ মৃত্যুসনদটাও ভুয়া। শ্রদ্ধেয় সাংবাদিক মতিউর রহমান চৌধুরী এ বয়সেও তরতাজা, সজীব। সংবাদের নেশায় এখনো ক্লান্তিহীন। ৬ মার্চ মানবজমিনে অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা কী তা আরেকবার দেখিয়ে দিলেন। ‘হারিছ চৌধুরী নয় মাহমুদুর রহমান মারা গেছেন’ শিরোনামে তাঁর অনুসন্ধানী রিপোর্টটি চাঞ্চল্যকর, অসাধারণ। এ রিপোর্টে মতিউর রহমান চৌধুরী খুঁজে বের করেছেন হারিছ চৌধুরীর পরিচয় বদলের আদ্যোপান্ত। পান্থপথে হারিছ চৌধুরীর আত্মগোপন, নতুন নাম ধারণ সব যেন থ্রিলার। তার পরও এ নিয়ে অনেকের সংশয়, সন্দেহ, অবিশ্বাস। পুরো ঘটনা দেখে শুনে আমার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কালজয়ী ছোটগল্প ‘জীবিত ও মৃত’র কথা মনে পড়ল। এ ছোটগল্পের কাহিনি বোধকরি সবারই জানা। এর একটি বাক্য বহুল প্রচলিত এবং আলোচিত। বাক্য হলো, ‘কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই।’ হারিছ চৌধুরী সত্যি যদি মাহমুদুর রহমান নাম নিয়ে মৃত্যুবরণ না করেন তাহলে কাদম্বিনীর মতো আত্মহত্যা করে তাকে তার পরিচয় উদ্ধার করতে হবে। ‘মরিয়া প্রমাণ করিতে হইবে তিনি মরেন নাই’। যদি সত্যি মৃত্যুবরণ করেন তাহলে ইতিহাসে কাপুরুষ, দুর্নীতিবাজ এক রাজনৈতিক চরিত্র হিসেবে আলোচিত হতে থাকবেন।

 

বাবর এবং হারিছ চৌধুরীর ঘটনা দুটি আপাতবিচ্ছিন্ন কিন্তু একসূত্রে গাঁথা। রাজনীতির পরিচয়ে অন্যায়, স্বেচ্ছাচারিতার পরিণতি ভয়াবহ। ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত হারিছ চৌধুরী ছিলেন কি অসীম ক্ষমতাবান। রাজা-বাদশাহদেরও এত ক্ষমতা থাকে না, যা এই ব্যক্তিটির ছিল। হারিছ চৌধুরীর স্বেচ্ছাচারিতার একটা উদাহরণ দিতে চাই। ২০০৩ সালের ঘটনা। স্বাস্থ্য খাতে তিল তিল করে সমৃদ্ধি অর্জন করা এক ব্যবসায়ীর কাছে ফোন এলো এক সন্ধ্যায়। অন্য প্রান্ত থেকে বলা হলো, ‘প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী স্যার কথা বলবেন’। ব্যবসায়ী ভদ্রলোক রাজনীতির সাতেপাঁচে নেই। একটু অন্তর্মুখী স্বভাবের মানুষ। ফোনটা কেটে দিলেন। এরপর আবার ফোন, আবার…। বিরক্ত হয়ে ভদ্রলোক ফোনটাই বন্ধ করে দিলেন। কিছুক্ষণ পর তিনি তার প্রতিষ্ঠান থেকে বেরোলেন বাসার উদ্দেশে। কিছুদূর যেতেই দুটো গাড়ি সামনে পেছনে থেকে তার গাড়ি আটকে দিল। গাড়ি দুটো থেকে কয়েকজন বেরিয়ে ঘিরে ধরল গাড়ি। কিছু বোঝার আগেই গাড়ি থেকে নেমে এলো সশস্ত্র অস্ত্রধারীরা। মুহূর্তেই ওই ব্যবসায়ীর চোখ বাঁধা হলো। ওই ব্যবসায়ীকে এক বাড়িতে নিয়ে গিয়ে চালানো হলো নির্মম নির্যাতন। এক পর্যায়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেললেন। যখন জ্ঞান ফিরল তখনো তার হাত-পা-চোখ বাঁধা। চোখ খুলে দেওয়া হলো এক পর্যায়ে। একটু ধাতস্থ হতেই দেখলেন সামনে হারিছ চৌধুরী। ১০ কোটি টাকা দিয়ে সে যাত্রায় প্রাণে বেঁচেছিলেন নিরীহ ভদ্রলোক। কোনো মামলা করেননি। কাউকে বলারও সাহস পাননি। ওয়ান-ইলেভেনের সময় এ কথাগুলো একবারই প্রকাশ্যে বলেছিলেন। এরপর তাকে মামলা করতে বলা হলে বিদেশ চলে যান। সেও ভয়ে। অনেক পরে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, মামলা করলেন না কেন। তিনি বলেছিলেন, হারিছ চৌধুরীরা ভয়ংকর। এরা আবার কখনো যদি ক্ষমতায় আসে আমাকে শেষ করে ফেলবে। কি প্রচণ্ড প্রতাপশালী হারিছ চৌধুরীর ১৪টি বছর কি দুঃসহ গ্লানিকর এক জীবন কেটেছে। ভাবা যায়। তাহলে কেন এত লোভ, এত কেন ক্ষমতার মোহ। কী হবে এসব দিয়ে। খন্দকার মোহতেশাম হোসেনেরও তো একই অবস্থা ছিল। ফরিদপুরে তাকে নাকি বলা হতো ‘ছোট রাজা’। আড়াই হাজার কোটি টাকার বেশি পাচার করেছেন। এখন কী হলো?

 

আমরা সবাই যদি অন্যায়ের পরিণতির কথা ভাবতাম তাহলে কি এত অন্যায়, দুর্নীতি, লুটপাট হতো? কিন্তু বাস্তবতা হলো স্বেচ্ছাচারিতার, সীমালঙ্ঘনের সময় কেউ পরিণতির কথা ভাবে না। মনে করে তারা অবিনশ্বর, চিরন্তন। কিন্তু সকালে আমির হয়ে বিকালে ভিখারিতে পরিণত হওয়ার চেয়ে সারা জীবন সাদামাটা সৎ একটা জীবন যে অনেক শান্তির তা বুঝতে কারও কারও এত কষ্ট কেন? এখন সমাজে হাতে গোনা যে কজন নব্য হারিছ কিংবা বাবর আছেন, তারা এসব দেখে কি কিছু শিখবেন?

লেখক : নির্বাহী পরিচালক, পরিপ্রেক্ষিত।

Email : [email protected]        সূএ:  বাংলাদেশ প্রতিদিন

Facebook Comments Box

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ



সর্বশেষ আপডেট



সর্বাধিক পঠিত



  
উপদেষ্টা -মাকসুদা লিসা
 সম্পাদক ও প্রকাশক :মো সেলিম আহম্মেদ,
ভারপ্রাপ্ত,সম্পাদক : মোঃ আতাহার হোসেন সুজন,
ব্যাবস্থাপনা সম্পাদকঃ মো: শফিকুল ইসলাম আরজু,
নির্বাহী সম্পাদকঃ আনিসুল হক বাবু

 

 

আমাদের সাথে যোগাযোগ করুন:ই-মেইল : [email protected]

মোবাইল :০১৫৩৫১৩০৩৫০

Design & Developed BY ThemesBazar.Com